ছাগলনাইয়া নামের উৎপত্তি নিয়ে ৩টি গল্প, পরিবর্তনের দাবী ও কিছু কথা 

মোঃ মাসুম বিল্লাহ ভূঁইয়া

ফেনী জেলার একটি উপজেলার নাম ছাগলনাইয়া। ছাগলনাইয়া নামের উৎপত্তি নিয়ে  সমাজে ৩ টি গল্প রয়েছে। কোন গল্পটি সঠিক, কোন গল্পটি মিথ্যা। এ নিয়ে লেখক , গবেষক ও বিশ্লেষকদের রয়েছে অনেক মতামত।

(১) কেউ বলে থাকেন, নোয়াখালীতে মহাত্মা গান্ধীর ছাগল চুরির ঘটনা থেকে ফেনীর ছাগলনাইয়া নামের উৎপত্তি।

(২) আবার কেউ কেউ দাবী করেন, সাগর নাইয়া থেকে ছাগলনাইয়া নামের উৎপত্তি।

(৩) আবার কেউ বলেন, ছাগল খাইয়া থেকে ছাগলনাইয়া নামের উৎপত্তি ।

(১) নোয়াখালীতে মহাত্মা গান্ধীর ছাগল হারিয়ে যাওয়া থেকে ছাগলনাইয়া নামের উৎপত্তি নিয়ে গল্পঃ

ছাগলনাইয়ার নামের উৎপত্তি নিয়ে মানুষের মুখে মুখে ১ টি মিথ্যা ও বানোয়াট গল্প প্রচলিত রয়েছে। যে গল্পটি শুনলে আমাদের তথা ছাগলনাইয়া উপজেলার পূর্ব পুরুষদের সম্পর্কে একটা খারাপ ধারনা আসে। গল্পটি হলো, নোয়াখালীতে  মহাত্মা গান্ধীর ছাগল চুরির ঘটনা। বলা হয়ে থাকে, মহাত্মা গান্ধীর ছাগল হারিয়ে যাওয়া থেকে ছাগলনাইয়া নামটির উৎপত্তি হয়।

 ১৯৪৬ সালে মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালী এসেছিল । ঐ সময়ে মহাত্মা গান্ধীর ছাগল হারিয়ে ছিল নোয়াখালীর চাটখিলে । ঐ সময়ে চাটখিলেই মহাত্মা গান্ধীর ছাগল জবাই করা হয়। ঐ ছাগলের রান্না করা মাংস মহাত্মা গান্ধীকেও খাওয়ানো হয়েছিল বলে জানা যায়। ঐ ঘটনা তথা নোয়াখালীর চাটখিলের সাথে ফেনীর ছাগলনাইয়া নামের উৎপত্তির কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না।

কারণ মাহাত্মা গান্ধীর ছাগল হারিয়ে যাওয়ার আগের এই এলাকার নাম ছাগলনাইয়া ছিল । গবেষনায় দেখা যায়, ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যাল কর্তৃক গৃহীত ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় একমাত্র বাঙ্গালী মুসলিম শিক্ষার্থী হিসেবে ফাস্ট ডিভিশন অর্জনকারী আলহাজ্ব মাস্টার ওয়াহিদুর রহমান ভূঁইয়া এই ছাগলনাইয়ার উত্তর সতর গ্রামের সন্তান, ১৯৪০ সালের মাস্টার ওয়াহিদুর রহমান ভূঁইয়ার মেট্রিকুলেশন পরিক্ষায় পাসের প্রত্যায়নপত্রে তাঁর ঠিকানা ইংরেজিতে Chhagalnaiya of Noakhali লিখিত রয়েছে।  গবেষনায় আরো ওঠে আসে ছাগলনাইয়া নাম করন হয়েছিল ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ মহাত্মা গান্ধি নোয়াখালীতে আসার পুর্বেই এই অঞ্চলের নাম ছাগলনাইয়া ছিল। সুতরাং মহাত্মা গান্ধির ছাগল চুরি ঘটনা থেকে ছাগলনাইয়া নামে উৎপত্তির এ গল্প  জগন্য মিথ্যা ও বানোয়াট।

(২) সাগরনাইয়া থেকে ছাগলনাইয়া নামের উৎপত্তি নিয়ে  আরেকটি গল্পঃ 

কেউ কেউ দাবী করেন, (Sagar) নামটি ভূল ক্রমে ছাগল (Sagal) হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে সাগরনাইয়া থেকে নাকি ছাগলনাইয়া হয়ে গেছে।  এ যুক্তির বিপক্ষে অবস্থান করছি।

যে কারনে সাগর থেকে ছাগল হবার কথা ভুল হতে পারে । সাগর নাইয়া অর্থ সাগরের মাঝি। কথাটি যেমন হাস্যকর তেমনি সাগরনাইয়া শব্দটিও অর্থহীন। সাগরনাইয়া নামের অর্থ সাগরের মাঝি। কিন্তু মাঝি হয় নৌকার। যারা সাগরনাইয়া নামক অর্থহীন ও হাস্যকর শব্দটি থেকে ছাগলনাইয়া নাম এসেছে মনে করেন, তারা কি আমাদের পূর্ব পুরুষকে মুর্খ প্রমাণ করতে চায়?

কিন্তু আমাদের পূর্ব পুরুষরা মুর্খ ছিল না। এখানে চাদঁগাজী ভূঁইয়া, শমসের গাজীরা ছাগলনাইয়ারই সন্তান। তারা ইংরেজি পারদর্শি ছিলেন। তাঁরা Sagar কে Sagal লিখবে – এটা বেশ অযৌক্তিক, সন্দেহজনক ও রহস্যজনক।

(৩) ছাগল খাইয়া থেকে ছাগলনাইয়া নামের উৎপত্তি নিয়ে কথিত গল্পঃ-

আমাদের ছাগলনাইয়ার নাম করনের উৎপত্তি নিয়ে আরেকটি গল্প রয়েছে। গল্পটি সত্য নাকি মিথ্যা। এ নিয়েও কোন লিখিত প্রমাদি না থাকলেও অলিখিত ইতিহাসের অংশ হিসেবে কথিত গল্পটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

কথিত গল্পটি হলো,

এই এলাকায় সাগর ছিলো। সাগরটির নাম ছিল বিল্লাহ সাগর মতান্তরে সুখ সাগর। সূত্র:( বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা ফেনী, বাংলা একাডেমি। পৃষ্ঠা নং ১১১। বইটিতে সাগরটির নাম বিল্লাহ সাগর মতান্তরে সুখ সাগর লিখা আছে।)

 ৪০০ বছর আগে এই সাগর পাড়ে এক রাখাল বাস করতো। রাখাল এখানে ছাগল পালন করে জীবিকা নির্বাহ করতো। একদিন রাখালের খুব ক্ষুধা লাগলো। ক্ষুধা লাগলো ছাগলেরও। এক দিকে ছাগল গেলে সাগরের কিনারায় পানি খেতে। রাখালও বাসায় গেলো খাবার খেতে। ঐ দিকে সাগরে একটি জোয়ার এসে ছাগলগুলোকে ডুবিয়ে নিয়ে গেল। রাখাল ঘর থেকে ফিরে এসে দেখলো, তার আদরের ছাগল একটাও নেই। তখন সে বুঝতে পারলো, জোয়ার এসে তার ছাগলগুলোকে নিয়ে গেছে।

তখন রাখাল ঐ সাগর পাড়ে বসে নিজের মাথা নিজেই মাটিতে আঘাত করতে লাগলো। সাগরের প্রতি ক্ষুদ্ধ হয়ে সাগরকে ছাগল খাইয়া, ছাগল খাইয়া বলে সাগরে ডিল ছুড়তো। 

যেই লোক এখানে আসতো মানসিক ভারসাম্য হারা সেই রাখালটির মুখে ছাগল খাইয়া নামটি শুনতো এবং সাগরে ডিল ছুড়ে মারতে দেখতো। ঐ সময়ে এ জায়গাটির নাম হয়ে গেলো, ছাগল খাইয়া। এরপর থেকে কয়েকশত বছর পরে এখানে গনবসতি গড়ে ওঠে। প্রায় ২০০ বছর পূর্বে স্থানীয় শিক্ষিতরা তারা জায়গাটির নাম ছাগল খাইয়া ব্যাপারে আপত্তি জানায়। পরে তারা গবেষনা করে দেখলো যে এখানে রাখালের ছাগলগুলো কে খেয়েছে, কেউ দেখেনি, এমনকি রাখাল নিজেও ছাগল খেতে দেখেন নাই। গবেষণার পর ঐ সময়ে তারা ভাবলো রাখাল এসে দেখলো, ছাগল নাই। তাই এ জায়গার নাম হওয়া উচিত ছাগলনাইয়া। ছাগল খাইয়া হতে পারে না। ছাগল খাইয়া নামের উৎপত্তির প্রায় ২০০ বছর পরে এ অঞ্চলের নাম দেওয়া হয় ‘‘ছাগলনাইয়া’’।

নাম পরিবর্তনের দাবী নিয়ে পক্ষ বিপক্ষ: 

ছাগলনাইয়া উপজেলার নাম পরিবর্তনের পক্ষে বিপক্ষে মতামত আছে। কেউ কেউ ছাগলনাইয়া নাম পরিবর্তন সাগরনাইয়া নাম করনের দাবী তুলেছেন।

আমি তাদের দাবীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ রেখেই জানতে চাই, যদিও সাগরনাইয়া থেকে ছাগলনাইয়া নামের উৎপত্তি নিয়ে গল্পটি আমার নিকট অযৌক্তিক মনে হয় এবং যদি ( Sagar) কে (Sagal) বলে ভুল লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে । তাহলে আবার সেই সাগরে যাওয়ার কি দরকার? পরবর্তী প্রজম্ম যে (Sagar) নামটি ভূল ক্রমে ছাগল (Sagal) লিখবে না, তার গ্যারান্টি কিভাবে দিবেন? 

যদি সাগরকে ভুল ভাবে ছাগলই লিখে, তাহলেতো সেই ভুল দ্বিতীয়বার করার সুযোগ কেন দিবেন? তাছাড়া সেই সুখ সাগর কিংবা বিল্লাসাগর এর অস্তিত্বও এখন আর নেই। যাহা নেই, তা নিয়ে মাতামাতি বেমানান।

তার চাইতে, আমার কাছে ছাগলনাইয়া নামটি ভালো মনে হয়। তাছাড়া আমাদের নাটক সিনেমার বিভিন্ন বিনোদনের ছলে হলেও ছাগলনাইয়া নামটি প্রায় ব্যবহার হয়ে থাকে। এতে করে আমাদের এ উপজেলার নামটি সারাদেশের মানুষ চিনে। এটা কম কিসের? 

অন্য নামে নাম করন করলে হয়তো এত আলোচনা হবেই না। আলোচনা না হলে তাতে কি আনন্দ লুকিয়ে আছে, তা আমার বোধগম্য নয়।

যদি কেউ ছাগলনাইয়ার নাম পরিবর্তন চেয়ে থাকেন। তবে কোন হাস্যকর ও অর্থহীন নামে পরিবর্তন নয়। বরং কোন অর্থবোধক শব্দ বা কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তির নামে নাম পরিবর্তন হোক।

যেমন, এ অঞ্চলের ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব শমসেরগাজী কিংবা চাঁদগাজীভূঁইয়া নামে পরিবর্তন হলে কোন বিতর্ক থাকবে না।

লেখক, মো: মাসুম বিল্লাহ ভূঁইয়া

সাধারণ সম্পাদক, বিএমইউজে, ফেনী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *